“যেই ঘুম ভাঙ্গে না-কো কোনদিন; ঘুমাতে ঘুমাতে শাশ্বত সুন্দর চির শান্তির সেই অমোঘ ঘুমে বড় অবেলায় ঘুমিয়ে পড়লেন হারিছ চৌধুরী!”
সায়হাম চৌধুরীর লেখা থেকে সংকলিত –
পাখিডাকা, ছায়াঢাকা বিরুলিয়ায় হারিছ চৌধুরী’র সমাধিস্হলে দাঁড়িয়ে কত কথা স্মৃতি মনে পড়ে! এখানে শেষ ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক, মনে হয় গোটা (কানাইঘাট -জকিগঞ্জ) ঘুমিয়ে আছে বীরত্ব গাঁথায় ভরপুর স্বাধীনতার সোনালী গৌরবের বুকে জড়িয়ে।
যেখানে পাখির কু’জনে বনবিথীর ছায়াতলে, সুরমার কলতানে মুখরিত, পুণ্যভুমি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগর গ্রামে প্রখ্যাত চৌধুরী পরিবারে জমিদার আব্দুল কাদির চৌধুরীর পুত্র, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রীদারী ব্রিটিশ ভারতের ক্যাডারে (আই,সি,এস) শফিকুল হক চৌধুরী, সি,ও এর পুত্র আবুল হারিছ চৌধুরী। ১৯৫৪ সালে যাঁর পরম গৌরবের জন্ম-কী নিভৃতে, অদূরে তার শেষ বিশ্রাম! যে মহানায়কের আজন্ম সাধনার সোনালী ফসল (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ)
কী নিদারুণ অবহেলায় কী নির্মম উপেক্ষায় তাকে সমাহিত হতে হয়েছিল সে কথা ভাবতেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে!
হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন হারিছ চৌধুরী’র খবর পেয়ে সুদূর লন্ডন থেকে কলিজার টুকরো মেয়ে ব্যারিষ্ট্রার সামিরা চৌধুরী শিশু পুত্র আলভিকে স্বামীর কাছে রেখে পাগলের মতো ছুটে আসেন তার জীবনের একমাত্র প্রদীপ বাবাকে দেখতে। শতকষ্টে হাজির হয়ে বিলাপ করে আর্তনাদ করতে থাকেন কোন জবাব পাননি বাবা তখন লাইফ সাপোর্টে! তিনি তখন চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে, চিকিৎসকরা একদিন দুইদিন করে এক সপ্তাহ চেষ্টা করেও পারলেন না! চিকিৎসদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষঘুমে ঘুমিয়ে পড়লেন!
কলিজার টুকরো মেয়ের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসলো, আসমান ভেঙে মাথায় পড়লো! দীর্ঘ পনের বছর পর বাবাকে দেখলেন তা-ও বাবার নিথর দেহ? বাবাকে কোথায় নিয়ে যাবেন কী করবেন চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারেন নি চিৎকার কিংকর্তব্যবিমুড় বাকরুদ্ধ! বাইশ বছর আগে উচ্চ শিক্ষার তাগিদে বিদেশ গিয়েছিলেন আত্মীয় স্বজন কে কোথায় ভালো করে জানেন ও না।
সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয়দের মধ্যে যোগাযোগ হলে বিশেষ করে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সাথে ফোনালাপও যোগাযোগ করলেন বার বার কিন্তু তিনি শুরু করলেন নতুন নাটক আর অভিনব ষড়যন্ত্র বাঁধা ভয় আর নিষেধের জালে গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে আসা একদম বন্ধ করে দিলেন!
লাশ নিয়ে একজায়গা থেকে অন্য জায়গা ছুটলেন সাভারের বিরুলিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হলো। অবশেষে ঠাঁই মিলল।
মৃত্যুর সংবাদ লোকমুখে শুনে অদূরে প্রিয় মাতৃভূমি (কানাইঘাট -জকিগঞ্জ) তথা গোটা সিলেটবাসী অসহায় আর্তনাদে নীরবে চোখের পানি পানি ফেলছিল লক্ষ লক্ষ শোকাতুর মানুষ,তারা সঠিক জানে না তাদের প্রিয়নেতা কোথায় সমাহিত?
অন্তিম যাত্রায় দেশের মন্ত্রীদের মতো জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত ফুলে ফুলে ঢাকা তার কফিন পায়নি সামান্যতম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা! একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় নেতার লাষ্ট পোস্টে বিউগলে বেজে ওঠেনি শেষ বিদায়ের করুন সুর। হারিছ চৌধুরীর যৌবনের উত্তাপ দিয়ে গড়া দর্পনগরের গোরস্থানে সমাধির দূ’গজ জমিও জুটলো না! স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্টার এই বদনসিব যে তাঁর মরদেহ সমাহিত হলো দর্পনগর থেকে ৫০০ মাইল দূরে যেমন আজন্ম অবহেলায় সমাহিত হয়েছিলেন রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে অনেক দুরে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে, দেশপ্রমিক সিরাজ উদ্দৌলাকে নারী লোলুপ লম্পট দুশ্চরিত্র শাসক বলে কলঙ্কের কালিমা লেপন করা হয়েছিল।
হারিছ চৌধুরী ও দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র ও নিজ দলের ভিতর বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার। তখন রাষ্ট্রের চোখে গ্রেনেড হামলার আসামি ও অনেক কিছু।
এ এক সুপরিকল্পিতভাবে ছুরি চালানো হলো স্বাধীনতার আদর্শের ওপর বিজয়ের নায়ককে হত্যা করে একে একে হত্যা করা হলো সুফলগুলো তার কৃতিকর্ম।
কিন্তু আমি তো দেখি আজ সমাধি থেকেই জেগে ওটা এক হারিছ চৌধুরীর বিশাল আবেদন।
(কানাইঘাট -জকিগঞ্জের) মানচিত্র সমান তাঁর অস্তিত্ব, চরিত্র হননের কোনো ছোরা দিয়ে কি নিধন করা হয়ে গেছে?
অবমূল্যায়নের কোনো বাটখারা দিয়ে ছেদন করা কি গেছে স্বাধীনতার এই বট বৃক্ষকে? না শত ষড়যন্ত্র, হাজারো চেষ্টার পরেও হারিছ চৌধুরী মরেননি, শারিরীকভাবে মৃত হলেও তিনি বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।
তাঁর মৃত্যু রহস্য নিয়ে নাটকীয়তা ষড়যন্ত্র ও মিথ্যার রাজনীতি করা হয়েছে,এসব তার জন্য দুধ ভাতের মতোই। যার হাত ধরে বড় হয়েছেন, নিজের যোগ্যতা না থাকা স্বত্বেও হারিছ চৌধুরীর পরিচয়ে নিজস্ব পরিচয়, বাড়ী গাড়ীর মালিক হলো তারাই একের পর ষড়যন্ত্রের জাল বুনল! কী নির্মমতা সাধারণ জনতা তাদের কখনো ক্ষমা করবে না।
যতদিন এই জনপদে সুরমা -কুশিয়ারার কলতান থাকবে ততদিন ও হারিছ চৌধুরী বেঁচে থাকবেন। তা-ইতো কবির ভাষায় বলতে হয়-
“যাহার অমর স্হান প্রেমের আসনে ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে দেশের মাটি থেকে নিল যারে হরি দেশের হৃদয় তাকে রাখিয়াছে বরি।”
হারিছ চৌধুরীর জন্য সিলেট ৫ আসনের ঘরে ঘরে অনুতাপ শুরু হয়ে গেছে। যেমন অনুতাপ শুরু হয়েছিল এ বাংলায় নবাব সিরাজ উদ-দৌলার জন্য। যেমন লুলুম্বা হত্যার অভিশাপে জর্জরিত আফ্রিকা, গ্রানাডার মাটি হজম করতে পারেনি মরিস বিশাপের রক্ত, চিলি হজম করতে পারেনি আলেন্দের রক্ত ঢাকার মাটিও কি হজম করতে পারবে হারিছ চৌধুরীর লাশ?
এই বিখ্যাত লাশ দর্পনগরে আনতে না দিয়ে ওরা বড় ভুলই করলো। তারা জানে না এই লাশ একদিন দর্পনগরে ফিরে যাবে সে দিন আর বেশি দুরে নয়, সে দিন দর্পনগর পরিণত হবে বিবেকবান হৃদয়বান দেশপ্রেমিক মানুষের তীর্থস্হানে।
এইতো ২৮ মে সেদিন হারিছ চৌধুরীর প্রতিচ্ছবি সামিরা চৌধুরী পিতৃভূমি দর্পনগর গিয়েছিলেন। হারিছ চৌধুরীর জন্য অনুতপ্ত হাজার হাজার মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা আর অকৃত্রিম শ্রদ্ধার প্রকাশই দেখেছি। এক নজর প্রিয় নেতার শেষ চিহ্ন দেখতে ভীড় আর ভীড়!
হারিছ চৌধুরী আপনি আপাতত এখানেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকুন। ঘাতকের ঘাতকের ষড়যন্ত্রের চেয়ে ও আপনি অনেক বলশালী, জাগ্রত জনতার হৃদয়ে আপনার আসব পাকাই রয়েছে। আপনার প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও হারিছ চৌধুরী আপনি আপাতত এখানেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকুন। ঘাতকের ঘাতকের ষড়যন্ত্রের চেয়ে ও আপনি অনেক বলশালী, জাগ্রত জনতার হৃদয়ে আপনার আসব পাকাই রয়েছে। আপনার প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও একদিন ফিরে পাবেন সে দিন হয়তো আর বেশি দুরে নয়।
“মুছিবে না চিহ্ন তাঁর শত যুগান্তরে,অনন্ত কালের মহা অনন্ত প্লাবনে। “
ওয়েবসাইট নকশা প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট
Leave a Reply